মোহাম্মদ আজিজুল হক স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় কম্পিউটারের বিভিন্ন অংশ একত্রে সংযুক্ত করে ব্যবহার উপযোগী করে প্রথম আয় শুরু করেন। এ কাজে তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তার সহপাঠী ও বন্ধু আবদুল্লাহ আল মাসুদ। শিক্ষার্থী হিসেবে তাদের নেওয়া এই উদ্যোগ পরবর্তীতে প্রযুক্তি খাতে ব্যবসায় আগ্রহী করে তোলে।
প্রথম উদ্যোগের সাফল্যের পরে, তারা প্রযুক্তি পরিষেবাগুলি যেমন গাড়ির ট্র্যাকিং সিস্টেম, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম এবং ডিজিটাল সেট টপ বক্স তৈরি করেছে। তিনি নেক্সডেকেড টেকনোলজি লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে প্রায় দেড় শতাধিক লোক কর্মসংস্থান করে। মোহাম্মদ আজিজুল হক, নেক্সটডেকেড টেকনোলজির চেয়ারম্যান, এসএমই এন্টারপ্রেনার অফ দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড ২০২১ (মাঝারি বিভাগ) বিজয়ী, প্রযুক্তি খাতে তার উদ্যোগ এবং তার সাফল্য সম্পর্কে কথা বলেছেন।
আলাপকালে তিনি বলেন, ১৫-২০ বছর আগেও দেশের সব পর্যায়ে প্রযুক্তির এতটা ব্যবহার ছিল না। এই খাতে কাজ করা লোকেরও বেশ অভাব ছিল। কিন্তু ঢাকা সিটি কলেজের কম্পিউটারবিজ্ঞানের ছাত্র মোহাম্মদ আজিজুল ও তাঁর বন্ধু আবদুল্লাহ আল মাসুদ সব সময় চাইতেন নতুন সব প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে। কিন্তু নিয়মিতভাবে কাজ পাওয়া যাচ্ছিল না তখন।
তাই উপার্জন কম থাকায় পরিবারের অনেকে এই কাজ ছেড়ে চাকরি খোঁজার পরামর্শ দেন। কিন্তু হাল ছাড়েননি দুই বন্ধু। প্রযুক্তি খাতে কিছু করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন তাঁরা। সেই চেষ্টাই শেষ পর্যন্ত সফলতা এনে দেয় তাঁদের।আজিজুল বলেন, “২০০৩-০৪ সালে, সম্পূর্ণ তৈরি কম্পিউটার খুব কমই পাওয়া যেত।
আলাদা যন্ত্রাংশ কিনে একত্রিত করতে হতো। এটাই ছিল প্রথম ব্যবসায়িক ধারণা যা আমার মাথায় এসেছিল। আমরা বিভিন্ন যন্ত্রাংশ সংযুক্ত করে সম্পূর্ণ কম্পিউটার বিক্রি শুরু করি। কাজটি করে তখন তিন-চার হাজার টাকা লাভ ছিল।এর পর চাঁদপুরের ছেলে মোহাম্মদ আজিজুল হার্ডওয়্যারের পাশাপাশি সফটওয়্যারের কাজে আগ্রহী হন।
সঙ্গী যথারীতি বন্ধু আবদুল্লাহ আল মাসউদ। সফটওয়্যার ও ওয়েবসাইট তৈরির জন্য দুজনে একসঙ্গে কাজ শুরু করেন। তাদের পুঁজি বাড়তে থাকে। আজিজুল বলেন, “আমি আর মাসুদ ওয়েব হোস্টিং ও ডোমেইন রেজিস্ট্রেশন করতাম। প্রতিটি কাজের জন্য ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা পেতাম। তখন থেকে বড় কিছুর জন্য টাকা জমাতে শুরু করি।
এভাবে কিছু সঞ্চয়ের পর দুই বন্ধু মিলে প্রযুক্তি খাতে তাঁদের যৌথ প্রচেষ্টাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার চিন্তা করেন। সেই চিন্তা থেকেই ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন নেক্সডিকেড টেকনোলজি। মাত্র ৭ লাখ টাকা আর ১৫ জন কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু করেন তাঁরা। এখন সেটি ২০০ কর্মীর প্রতিষ্ঠান।
নিজেদের জমানো পুঁজি আর নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে নেওয়া ঋণে ছিল প্রতিষ্ঠানটির প্রাথমিক পুঁজি। আজিজুল জানান, প্রতিষ্ঠানের নাম পছন্দের পেছনেও কাজ করেছে তাঁদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। নেক্সডিকেড, অর্থাৎ পরবর্তী দশকের সম্ভাব্য প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার উদ্দেশ্য তাঁদের।আগের কাজের পাশাপাশি, দুই বন্ধু নতুন কোম্পানির মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য পুনরাবৃত্ত (বিল অ্যাকাউন্টিং) সফ্টওয়্যার তৈরি করতে শুরু করে।
এছাড়াও অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবসা গবেষণা সময় ব্যয়. এই গবেষণার সাফল্য আসে দুই বছর পর। আজিজুল বলেন, ‘২০০৮ সালের দিকে দেশে গাড়ি ট্র্যাকিং প্রযুক্তি ছিল না। কিন্তু প্রতিবেশী দেশ ভারতে ছিল।আমরা দেখেছি, প্রযুক্তি ব্যবহার করে গাড়ির স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তৈরি করা গেলে গাড়িটিকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখা সম্ভব। এটি গাড়ি চুরিও কমাতে পারে। এই চিন্তা থেকেই তারা ২০০৮ সালে (VTS) নামে একটি প্রযুক্তি তৈরি করেন। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে গাড়ির মালিক সব সময় গাড়ির অবস্থান জানতে পারবেন।
ভিটিএস তৈরি করার পরও তিনি এর বিপণন নিয়ে সংকটের সম্মুখীন হন। তাই, ২০১০ সালে, তিনি এই নতুন প্রযুক্তি পরিষেবা আরও গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য টেলিকম সেক্টরের একটি সংস্থার সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। পরে তারা ভিটিএস প্রযুক্তির জন্য টেলিকম খাতের আরও দুটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে। ব্যবসা বাড়ার সাথে সাথে নতুন মূলধনের প্রয়োজন দেখা দেয়। তাই দুই বন্ধু নতুন বিনিয়োগ শর্তে ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে দুজনকে যুক্ত করেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাদের।
এখন পর্যন্ত, প্রায় ৪0,000 গ্রাহক নেক্সটডিকেড দ্বারা তৈরি VTS প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। বর্তমানে প্রাইভেট কার ছাড়াও বাস, ট্রাক, সিএনজি ও জলযানে তাদের ট্র্যাকিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। আর ভিটিএস প্রযুক্তির সহায়তায় এ পর্যন্ত প্রায় আড়াই শতাধিক চোরাই গাড়ি উদ্ধার করা হয়েছে।
ভিটিএস সাফল্যের পর আজিজুল আর মাসুদ মিলে কাজ শুরু করেন ওটিটি প্ল্যাটফর্ম তৈরির। আজিজুল বলেন, ‘আমরা দেখলাম বিনোদনজগতে ওটিটি হতে যাচ্ছে ভবিষ্যৎ জনপ্রিয় মাধ্যম। তাই এটা নিয়ে জোরেশোরে কাজ শুরু করি। প্রাথমিক একটা কাঠামো দাঁড় করানোর পর ২০১৯ সালে টেলিকম খাতের কোম্পানি বাংলালিংকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে “টফি” নামে একটি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করি। এখন দেশের ওটিটি প্ল্যাটফর্মকে নেটফ্লিক্স, আমাজনের মতো বৈশ্বিক পর্যায়ে নেওয়ার স্বপ্ন তাঁদের।
এদিকে সরকারি এক সিদ্ধান্তের কারণে গত বছর থেকে দেশে ডিজিটাল সেট টপ বক্সের ব্যবহার বাড়ছে। কিন্তু অন্যান্য দেশে এই প্রযুক্তির ব্যবহার দেখে ২০১৪ সালেই সেটির গুরুত্ব বুঝেছিলেন আজিজুল ও মাসুদ। ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বুঝতে পেরে দুই বন্ধু আরও চার অংশীদারকে সঙ্গে নিয়ে ডিজিটাল সেট টপ বক্স তৈরি শুরু করেন।
তবে এবার নেক্সডেকেডের পরিবর্তে প্লাস টেক ইন্ডাস্ট্রিজ নামে একটি আলাদা সাবসিডিয়ারি খোলেন। আজিজুল বলেন, বর্তমানে দেশে প্রায় ১০ লাখ ডিজিটাল সেট টপ বক্স ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় দুই লাখ টাকা তাদের প্রতিষ্ঠানের। চীনা প্রযুক্তি ও কাঁচামাল দিয়ে তৈরি এসব সেট টপ বক্স দেশে শুধুমাত্র তাদের কোম্পানিই তৈরি করে।
আজিজুল জানান, বর্তমানে সেট টপ বক্স তৈরির কাজের যুক্ত রয়েছেন ৩৩ জন কর্মী। যেভাবে ব্যবসা প্রসারিত হচ্ছে, তাতে আগামী বছর তাঁদের প্রতিষ্ঠানের লেনদেন দাঁড়াবে ৪০ কোটি টাকায়। এ অবস্থায় দেশের তরুণদের প্রযুক্তি খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে সারা দেশের সব উপজেলায় সফটওয়্যার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলার স্বপ্ন আজিজুলের। তাঁর মতে, প্রযুক্তি হচ্ছে একটি সম্প্রসারণশীল ও সম্ভাবনাময় খাত। তাই কোনো অবস্থাতেই হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না। জানাশোনার পরিধি বাড়ালে আর লেগে থাকলে এ খাতে সফলতা আসবেই। সূত্র: প্রথমআলো।